কয়েক বছর আগেও হাওড়ের যে জায়গাগুলো ছিল পতিত, সেখানে এখন সবজি চাষে বদলে গেছে দৃশ্যপট। এ বছর আড়াই হাজার একর অনাবাদি পতিত জমিতে অর্গানিক পদ্ধতিতে মিষ্টি কুমড়া, আলু, বাদাম, পেঁয়াজ, রসুন, সূর্যমুখী, গম, ভুট্টা, মরিচসহ বিভিন্ন জাতের সবজি চাষ করা হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা, উপজেলা প্রশাসন ও কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২৮৬ দশমিক ৮৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের খালিয়াজুরি ও ২২৫ দশমিক ৮৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মদন উপজেলায় ছোট-বড় প্রায় ৯৪টি হাওড় রয়েছে। বছরের প্রায় সাত মাস পানিতে নিমজ্জিত থাকে এসব হাওর। হাওরে একমাত্র ফসল বোরো ধান। প্রায় ৩ লাখ ১৫ হাজার জনসংখ্যার দুটি উপজেলায় কৃষিজমির পরিমাণ প্রায় ৫২ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে মদনে দুই ফসলি জমির পরিমাণ ১০ হাজার ৩৫০ হেক্টর, খালিয়াজুরিতে শুধু ৪৪৫ হেক্টর। আর অন্য জমিগুলো এক ফসলি।
কয়েক বছর আগেও হাওড়ে এসব এক ফসলি জমিতে বোরো ধান চাষাবাদ করতেন কৃষকেরা। কোনো বছর ভালো ফলন হলে তারা লাভবান হন। আবার অকালবন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে মাথায় হাত পড়ে। এভাবেই পরিবার-পরিজন নিয়ে হাওড়াঞ্চলের কৃষকেরা আনন্দ-বেদনায় জীবনযাপন করেন। এবার অধিকাংশ কৃষকই অনাবাদি জমিতে সবজি চাষে ঝুঁকছেন। অবশ্য তিন বছর ধরে হাওরে সবজি চাষ শুরু হলেও এবার পরিধি বাড়ছে।
খালিয়াজুরির নূরপুর-বোয়ালি গ্রামের শাহ মো. সোয়েব ঢাকায় একটি বেসরকারি কারখানায় চাকরি করতেন। করোনা শুরুর বছরখানেক পর চাকরি হারিয়ে তিনি বাড়িতে চলে আসেন। আর মদন উপজেলার গোবিন্দশ্রী গ্রামের মো. হাইদুল মিয়া স্থানীয় বাজারে মুদির দোকানদার ছিলেন। করোনা শুরুর পর তার ব্যবসায় ধস নামে। দুই বছর ধরে তিনিও বাড়িতে এসে বেকার জীবন কাটান। এবার হাওরে পতিত জমিতে তারা মিষ্টি কুমড়া চাষ করে প্রথমবারেই বাজিমাত করে দেন, দেখছেন লাভের মুখ। তাদের মতো অনেকেই লাউ, মরিচ, গোল আলু, মিষ্টি আলু, বাদাম, শর্ষে, ভুট্টা, ক্ষীরাসহ সবজি চাষ করে লাভবান হচ্ছেন।
হাইদুল মিয়া যুগান্তরকে বলেন, কৃষি বিভাগের পরামর্শে আধুনিক পদ্ধতিতে লাউ ও মরিচ চাষ শুরু করছি। প্রথমবারেই আমি সফলতার মুখ দেখছি। যে টেহা (টাকা) খরচ হইছে, আগাম সবজি বিক্রি কইরা তা এখন উইঠা গেছে। কিছু টেহা লাভ হইতাছে। আমার চাষ দেইখ্খা গ্রামের অনেকেই সবজি চাষে মন দিতাছেন।
মদনের সবজিচাষি নজরুল ইসলাম বলেন, উৎপাদিত সবজি ও শস্য এলাকার চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ঢাকা, নেত্রকোনা, ও কিশোরগঞ্জসহ অন্যান্য জেলাতেও সরবরাহ করা হচ্ছে। পাইকাররা সরাসরি চাষিদের ক্ষেত থেকে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এলাকার চাষিদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রত্যেকটি জমি কৃষি বিভাগের মাঠ কর্মীদের মাধ্যমে নিবিড় তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছে। চাষিদের প্রাকৃতিক বালাইনাশক পদ্ধতি ও জৈবসার ব্যবহারে উৎসাহিত করা হয়েছে।
একই এলাকার তিয়শ্রী গ্রামের কৃষক রবিউল জানান, তারা দুইজনে মিলে ৮০ শতক পতিত জমিতে মিষ্টি কুমড়া চাষ করেছেন।
জাওলা গ্রামের কৃষক শ্যামল চন্দ্র দাস বলেন, আমি ৪০০ শতক জমিতে মিষ্টি কুমড়া চাষ করেছি। বোরো ফসল তুলতে গিয়ে আগাম বন্যার (পাহাড়ি ঢলের) ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হয়; কিন্তু সবজি চাষে ঝুঁকি কম। এছাড়া ধানের তুলনায় লাভও বেশি।
খালিয়াজুরীর চাকুয়া ইউনিয়নের লেপসিয়া গ্রামের সমাজসেবক আবুল কাসেম বলেন, প্রশাসনের উৎসাহে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে নদীর পাড়ে শাক-সবজি আবাদের জন্য কৃষকদের উৎসাহিত করা হয়েছে। উৎপাদনও ভালো হয়েছে। এতে এলাকার অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে।
খালিয়াজুরির কৃষি কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, তার উপজেলার নূরপুর, বোয়ালি, রসুলপুর, জগন্নাথপুর, খালিয়াজুরি সদর, লেপসিয়া, চাকুয়া, পাঁচহাট, মেন্দিপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ৪৪০ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬৫ হেক্টর জমিতে মিষ্টিকুমড়া চাষ করা হয়। এ পর্যন্ত উৎপাদিত হয়েছে ৫ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন। আরও ২০০ মেট্রিক টন উৎপাদনের আশা রয়েছে। এসব মিষ্টিকুমড়ার বাজারমূল্য প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি টাকা।
মদন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আহসান হাবিব বলেন, মদনে হাওরের ৫০ হেক্টর জমিতে লামিয়া, ওয়ানাডার বল, ব্ল্যাক সুইট, সন্ধানী, শীলা ইত্যাদি জাতের মিষ্টিকুমড়া চাষ করা হয়। বেশি চাষ হয়েছে তিয়োশ্রী, গোবিন্দশ্রী, মাঘান, ফতেপুর এলাকায়। ফলন বেশি ও আগাম জাতের এসব সবজি চাষ করে কৃষকেরা ভালো লাভবান হচ্ছেন।
এদিকে নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক শাহেদ পারভেজ যুগান্তরকে বলেন, হাওড়ের পতিত জমিতে সবজি চাষের কাজটা শুরু হয়েছিল তিন বছর আগেই। আমরা এটার ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রণোদনার সার বীজসহ আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সহযোগিতা দিয়ে আমরা কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি। এজন্য ওই এলাকায় মৌসুমি সবজির বাম্পার ফলন হয়েছে। খরচের তুলনায় কৃষকরা কয়েকগুণ লাভ পাচ্ছেন।