জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্রী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা আত্মহত্যা করেছেন। শুক্রবার রাতে কুমিল্লার বাগিচাগাঁওয়ের বাসা থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। আত্মহত্যার আগে ফাইরুজ তার এক সহপাঠী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টরের বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগ এনে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। এই নিয়ে চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে চলছে সমালোচনা।
জোবাইর সিদ্দিক নামে এক ব্যক্তি অবন্তিকাকে নিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, সুইসাইড কোনো কিছুর সমাধান না। যাদের জন্য সেই সুইসাইড করতে বাধ্য হয়েছে বলে উল্লেখ করে গেছে তাদের সুষ্ঠু তদন্ত করে বিচারের আওতায় আনা হোক।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী এবং এখন টিভির জয়েন্ট নিউজ এডিটর আনিসুর সুমন তার ফেসবুক টাইমলাইনে লেখেন, ‘ফাইরুজ অবন্তিকা নামে একটা জলজ্যান্ত মানুষ ঘোষণা দিয়ে নাই হয়ে গেল!
মেয়েটা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পড়ত। ২০২২ সালের দিকে মেয়েটার সঙ্গে কথা হয়। লেখালেখির প্রতি ওর খুব ঝোঁক। কাজের প্রতিও সমান ইচ্ছে ছিল। মূলত ফাইরুজই আমাকে খুঁজে বের করে লেখার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে। পরে ওর নামে কয়েকটি বাইলাইন ফিচার স্টোরি পত্রিকায় আমি ছাপি।
কিছুক্ষণ আগে নিউজ দেখে পরিচিত লাগল। পরে ওর ফেসবুকে ঢুকে আঁতকে উঠলাম। আহা, একটা তরুণ প্রাণ বিচার চেয়ে না পেয়ে উল্টো আত্মহত্যার পথ বেছে নিল। যাওয়ার আগে তার দেওয়া তথ্যমতে দুই অপরাধীর নাম প্রকাশ করে বিস্তারিত লিখে গেছে।
মেয়েটা মরেও কী শান্তি পাবে? কালপ্রিট দুটোর শাস্তি চাওয়া ছাড়া কিইবা বলার আছে। ’
দেলোয়ার হোসেন ঢালী নামের একজন লেখেন, ঘটনাকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে, আসল খুনিকে শাস্তি প্রদান করা হোক।
নওশিন তাবাসসুম প্রাপ্তি নামে অবন্তিকার এক শুভাকাঙ্ক্ষী তার নিজের প্রোফাইলে লিখেছেন, মেয়েটা আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো, খুবই এডমায়ার করত। এটা আমার কথা না, এটা যারা একটু হলেও ভালো করে জানে অবন্তিকাকে, তারা জানবে আমার কথা।
অবন্তিকার সঙ্গে আমার পরিচয় ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারে হলেও ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ওর বিএমএ থেকে আসার পর। ওর কিছু পোস্ট দেখে আমার মনে হয়েছিল মেয়েটা ভালো নেই, ওর কাছ থেকে জানতে চাইলে, ও আমাকে গড়গড় করে সব বলে দেয়।
তখন থেকে আমার কাছে ওর শেয়ার করা শুরু এবং হেন কিছু নেই সে আমাকে শেয়ার করেনি। আমি শুধু অবন্তিকার কথাই বলব, যে কথাটা অবন্তিকা বুক ফেটে সবাইকে বলতে চাইত এবং এটাও প্রমাণ করতে চাইত, তোমরা যারা অবন্তিকাকে এতটা খারাপভাবে মানুষের কাছে রিউমার ছড়াচ্ছো, সে এতটা খারাপ না। সে খুবই সাধাসিধে একটা মেয়ে, যাকে কেন্দ্র করে তোমরা জটিল গল্প বানাচ্ছো, সে গল্পগুলো বিশ্বাসও করে ফেলেছ একটা বার তার সঙ্গে কথা না বলে।
সে আমার কাছে আর্তনাদ করে বলত, প্রাপ্তি! আমি এত খারাপ মেয়ে না! আমি এটা কাকে বিশ্বাস করাব? ওরা এই আটজন এমনভাবে আমাকে নিয়ে বাজে কথা বলেছে, প্রত্যেকটা মানুষের কাছে গিয়ে গিয়ে আমি কয়জনকে প্রমাণ করব? কেউ আমার কথা শুনবে?
আমি এই অবন্তিকার কথাই বলব। আমাকে শুধু সময় দিন। আপনারা এর মাঝে চিন্তা করতে থাকেন, মেয়েটাকে নিয়ে কি পরিমাণ বাজে কথা ছড়ানো হয়েছিল, কোন মুখ গুলো ছড়াচ্ছিল সেটা মনে করতে করতে।
আমি ওর সব কথা হয়তো মনে করে বলতেও পারব না। আপনারা যারা রিউমার শুনেছেন, সেটা আমাকে মনে করায় দিতে সাহায্য করবেন।
আফিয়া নামে এক মেয়ে তার নিজের পেইজে লিখেছেন, অবান্তিকার হত্যার দায় শুধু দুজনের না৷ আমাদের পুরো জগন্নাথের। একজন প্রক্টর এমন পিশাচ হইল না হয়! প্রক্টরিয়াল বডির বাকিরা কেন নীরব ভূমিকায় ছিল? এই নীরবতা তো ওই একজনের অন্যায়কে মৌন সমর্থন দেওয়া।
বিভাগীয় চেয়ারম্যানের কাছেও নাকি বারবার নালিশ করেছিল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় চেয়ারম্যান যথেষ্ট পাওয়ারফুল হন। উনি চাইলে পারতেন মেয়েটিকে রক্ষা করতে। বিভাগের অন্যান্য শিক্ষকও কি একদিনও খেয়াল করলেন না যে একজন শিক্ষার্থী এতটা খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে?
আর ভিকটিমের বন্ধুবান্ধব যারা আছেন, আপনারা অনেকেই নাকি জানতেন বিষয়গুলো। দোষীদের একজন আপনাদেরই সহপাঠী। তবু আপনারা কিছু করতে পারলেন না?
সবাই মিলে কি কিছু করা যেত না? আর না হোক অন্তত মানসিক সাপোর্টটা তো দিতে পারতেন। পৃথিবীর কোনো কিছুই মানুষের স্বেচ্ছামৃত্যুর কারণ হতে পারে না, যদি ব্যক্তি মানসিকভাবে শক্ত থাকেন। যত রোগবালাই বলুন আর বিপদ বলুন— সবকিছুই আপনাকে তখন কাবু করবে, যখন মানসিকভাবে আপনি একা হয়ে যাবেন, ভেঙে পড়বেন।
মেয়েটা লড়াই করতে করতে যখন আশপাশে তাকিয়ে দেখল সে একদম একা! কেউ নেই পাশে! তখনই শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।
শ্রদ্ধেয় উপাচার্য সাদিকা হালিম ম্যামের কাছে অনুরোধ— সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে জগন্নাথের এই কলঙ্ক দূর করুন।
অভিযুক্ত সহকারী প্রক্টরের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে ফেসবুকে দেওয়া বিভিন্ন ছবি দিয়ে পুলিন বকসী নামের একজন ক্যাপশনে লেখেন— ফাইরুজ অবন্তিকা মেয়েটি সুইসাইড করেছে। মেয়েটির শেষ স্ট্যাটাস অনুযায়ী বলা উচিত তাকে হত্যা করা হয়েছে। মেয়েটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও তার সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকীকে এই ‘হত্যাকাণ্ডে’র জন্য দায়ী করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দ্বীন ইসলাম এবং ওই সহপাঠীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে। কিন্তু আমার ধারণা, দ্বীন ইসলামের শেষমেশ কিছুই হবে না। তার শেকড় অনেক গভীরে।
কাজী মামুন নামের একজন তার ফেসবুক টাইমলাইনে লেখেন, মাত্র এক বছর বাবাকে হারানো ফাইরুজ অবন্তিকা নামের এই মেয়েটিকে ‘হত্যা’ করা হয়েছে। আত্মহত্যা না বলে হত্যা বলছি। কারণ মেয়েটার ফেসবুকে পোস্ট করা সুইসাইড নোটে এটা স্পষ্ট যে আম্মান সিদ্দিকী নামক তার এক ক্লাশমেট দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতন আর হয়রানি করে করে এমন একপর্যায়ে নিয়ে গেছে, তার আর উপায় ছিল না। জগন্নাথের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামও জড়িত। বারবার অভিযোগ করার পরও কোন সুরাহার পরিবর্তে এই দ্বীন ইসলাম নিজেও তাকে মানসিক নির্যাতন করেছে। সুবিচার চেয়ে না পেয়ে কুমিল্লা সরকারি কলেজের প্রয়াত শিক্ষক জামাল উদ্দিন স্যারের ছোট মেয়েটা অবশেষে মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছে, তবু যদি কিছু হয়। মেয়েটা তো জীবন দিলই এবার কী অন্তত বিচার নিশ্চিত করতে পারি আমরা?
একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক আল আমিন নামের তার ফেসবুক টাইমলাইনে লেখেন— একজন হয়তো ফাঁস নেওয়ার আগে অনেককেই অভিযোগ জানিয়েছিলেন ফাইরুজ অবন্তিকা; কিন্তু প্রতিক্রিয়া পাবেন হয়তো এবার লাশ হওয়ার পর!
আসমিতা ইসরাত নামে একজন ফেসবুক কমেন্টে লেখেন, কতটা ডিপ্রেশনে গেলে এত স্ট্রং একটা মানুষ যে কিনা অন্যদের আত্মহত্যা করতে নিষেধ করত সেই গতরাতে এই পথ বেছে নিল।