ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসার ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে গৃহকর্মী প্রীতি ওড়ানকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তার মা নমিতা ওড়ান।
মঙ্গলবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে কিশোরী গৃহকর্মী প্রীতি ওড়ান ‘হত্যাকাণ্ডের’ সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে আয়োজিত মানববন্ধন কর্মসূচিতে তিনি এ অভিযোগ করেন। সচেতন নাগরিক সমাজের ব্যানারে এ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।
দেশবাসীর উদ্দেশে নমিতা ওড়ান বলেন, আমরা গরিব মানুষ বলে কি আপনাদের কোনো দয়া-মায়া নাই? এভাবে কি একটা গরিবের মেয়েকে বিল্ডিং থেকে ফালানো লাগে? এভাবে অত্যাচার করা লাগে? আমার মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই।
তিনি বলেন, আমি গরিব মানুষ। এর জন্য আমার মেয়েকে এখানে কাজের জন্য পাঠিয়েছিলাম। আমার মেয়েকে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়েছে। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার মেয়ে হত্যার বিচার চাই। সুষ্ঠু বিচার চাই।
মেয়ে হত্যার বিচারের দাবি জানিয়ে প্রীতির বাবা লোকেশ ওড়ান বলেন, আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার মেয়ে হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই।
প্রীতির চাচাতো বোন কবিতা বলেন, আমরা চা শ্রমিক। আমরা গরিব-দুঃখী মানুষ। আমার বোনকে কাজের জন্য ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম। এখন আমরা এতদূর থেকে ঢাকায় এসেছি আপনাদের কাছ থেকে সুষ্ঠু বিচার পাওয়ার জন্য। আমরা শেখ হাসিনার কাছে এর বিচার চাই।
প্রীতির কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে তার দাদা সংকর তাঁতী বলেন, আমরা চা শ্রমিক। আমরা সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকি। আমরা এখান থেকে অনেক দূরে থাকি। আমরা আমাদের সন্তানকে খাওয়াতে-পরাতে পারি না বলে বাধ্য হয়ে ঢাকায় কাজ করতে পাঠাই; কিন্তু সে এখানে এসে যে নির্যাতিত হয়েছে এটা আমরা মানতে পারি না। আমরা চাই প্রীতির মতো আর কোনো শিশু যেন এমন নির্যাতনের শিকার না হয়। আমাদের আর কোনো বাচ্চা যেন পথে-ঘাটে পড়ে না মরে। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই।
এদিকে গৃহকর্মী প্রীতি ওড়ানের মৃত্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করে দায়ী ব্যক্তিদের বিচার দাবিতে একই সময়ে প্রেস ক্লাবের সামনে পৃথক মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক নামের একটি সংগঠন। এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে সে বিষয়ে সরকার ও প্রশাসনকে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয় সংগঠনটির পক্ষ থেকে।
গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক আয়োজিত মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন ১২টি জাতীয় ট্রেড ইউনিয়নের জোট শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুল ওয়াহেদ। সঞ্চালনা করেন গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের ভারপ্রাপ্ত সমন্বয়কারী আবুল হোসেন।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন- জাতীয় গার্হস্থ্য নারী শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মুরশিদা আক্তার নাহার, ব্লাস্টের সিনিয়র আউটরিচ অফিসার আমান উল্লাহ প্রমুখ।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৮টার দিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আবাসিক ভবনের নবম তলা থেকে পড়ে কিশোরী গৃহকর্মী প্রীতি ওড়ানের (১৫) মৃত্যু হয়। ওই ভবনের বাসিন্দা সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসায় প্রীতি কাজ করতেন। তার বাড়ি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মিত্তিঙ্গা গ্রামে।
প্রীতির মৃত্যুর দিন প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিলেন, মেয়েটিকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধারের সময় তার শরীরে জামা থাকলেও পরনে কোনো কিছু ছিল না। মনে হচ্ছিল তাকে ধর্ষণ করে উপর থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় মারধরের কালো দাগ ছিল। এছাড়া মাঝেমধ্যে ওই বাসা থেকে মেয়েটির চিৎকার করে কান্নার শব্দ শোনা যেত বলে স্থানীয়রা জানিয়েছিলেন।
ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকার। ছবি-ফেসবুক
ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকার। ছবি-ফেসবুক
পরদিন ৭ ফেব্রুয়ারি আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকারের বিরুদ্ধে মামলা করেন নিহতের বাবা লুকেশ ওড়ান। মামলায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ আনা হয়। একই দিন আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ রিমান্ড চাইলে আদালত নামঞ্জুর করে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেন।
জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আজ মঙ্গলবার আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকারকে আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই নাজমুল হাসান তাদের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুর রহমান তাদের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
উল্লেখ্য, গত বছরের ৬ আগস্ট একই ধরনের ঘটনা ঘটে আশফাকুল হকের বাসায়। ওই সময় ৯ বছরের শিশু গৃহকর্মী ফেরদৌসি লাফিয়ে পড়ে গুরুতর আহত হয়। ওই ঘটনায় নির্যাতনের অভিযোগ এনে আশফাকুল হক, তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকার ও শিল্পী নামের আরেক নারীকে আসামি করে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেছিলেন শিশুটির মা।