দীর্ঘ ৯ বছর পর রাজনীতিবিদ ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিশিষ্টজনদের নিয়ে ইফতার মাহফিল করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। শনিবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে রাজনীতিবিদদের সৌজন্যে ইফতারের আয়োজন করে দলটি। এতে বিএনপিসহ সমমনাদলগুলোর নেতাকর্মী, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের বিশিষ্টজনরা অংশ নেন।
ইফতারপূর্ব সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, বিনা সংগ্রামে মুক্তি আসে না। এ জাতিকে মুক্তির জন্য আরেকটিবার বুক সটান করে দাঁড়াতে হবে। এখন যারা ক্ষমতায় আছেন আমরা তাদের শত্রু নই। আমরা দোয়া করি আল্লাহ যেন তাদের হেদায়েত দেন। আমাদের ওপর আঘাত এলে তার প্রতিরোধ করার দায়িত্ব আমার আছে। কেউ পায়ে পারা দিয়ে বিবাদ করতে এলে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম বলেন, ২০১৫ সালের পর এবার ইফতারের আয়োজন করেছেন তারা।
গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলছে জামায়াত। আগে নেতাকর্মীরা বারবার জামিন পেলেও কারাফটক থেকে ফের নতুন মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন; কিন্তু দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর দলের আমির ডা. শফিকুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা একে একে মুক্তি পেয়েছেন।
নতুন সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির মতো কর্মসূচি দিতে পারেনি নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলো। বাংলাদেশে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের রেশ কাটিয়ে ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচির মাধ্যমে রাজনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো আর ‘অনানুষ্ঠানিকভাবে’ স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে অংশ নেওয়ার কৌশল নিয়ে এগুতে চাইছে জামায়াতে ইসলামী।
দলের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে আরও যেসব ধারণা পাওয়া গেছে তা হলো, বিএনপিসহ যেসব রাজনৈতিক দল গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেছে তাদের মধ্যকার ‘সুসম্পর্ক’ বজায় রেখে ‘স্বতন্ত্র’ বা পৃথকভাবে অগ্রসর হওয়ার কথা ভাবছে জামায়াত।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বিবিসি বাংলাকে বলেন, আওয়ামী লীগের মতো একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারকে হটিয়ে ভোটের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা এককভাবে কোনো দলের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এ ইস্যুতে যেসব দল একমত তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেই আমরা নিজেদের মতো করে কর্মসূচি পালন করে যাব। এরপর জনগণ যদি চায় সবাই মিলে এগিয়ে যাক তখন সেই পরিস্থিতি অনুযায়ী আমরা পদক্ষেপ নেব।
দলের একজন মুখপাত্র মতিউর রহমান আখন্দ বলেন, এখনই সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলনের পরিকল্পনা দলটির নেই। আমরা সরকারকে সময় দেব এবং সামনের জন্য প্রস্তুতি নেব।
এদিকে রাজনৈতিক এমন বিশ্লেষণের মধ্যেই শনিবার রাজনীতিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সম্মানে ইফতারের আয়োজন করে দলটি। অনেকেই মনে করছেন এর মাধ্যমে দলটি গত নির্বাচনের আগে থেকেই একে অপরের সঙ্গে তৈরি হওয়া দূরত্ব কমিয়ে এনে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়াতে চাইছে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি।
যদিও এখনি ‘এক মঞ্চে আসা’ কিংবা ‘জোট’ করার কোন উদ্যোগ বা আগ্রহ কোনোপক্ষেরই নেই বলে জামায়াত নেতারা জানিয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলেন, তার ধারণা জামায়াত এখন জনসংযোগ হবে এমন নিয়মিত রাজনৈতিক কর্মসূচির দিকেই বেশি আগ্রহী হবে।
তিনি আরও বলেন, অনানুষ্ঠানিকভাবে হয়তো তারা এমন কর্মসূচিই হাতে নেবে যেখানে মানুষের কাছে যাওয়া যায় এবং একই সঙ্গে বিএনপিকেও আশ্বস্ত করা যাবে যে সরকার বিরোধী আন্দোলনেও আছি।
চাপে জামায়াত: আদালতের একটি রায়ের ভিত্তিতে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন কমিশন জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছিল।
এরও আগে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শীর্ষ নেতাদের সাজা এবং প্রায় এক দশক প্রকাশ্য রাজনীতিতে অনুপস্থিতি এবং সরকারের নানামুখী চাপে থাকার পরেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে বরাবরই একটা অবস্থান দেখা যায় দলটির।
১৯৯১ সালে জামায়াতের সমর্থনে এবং ২০০১ সালে জামায়াতকে জোটে নিয়েই সরকার গঠন করেছিল বিএনপি।
মূলত গত প্রায় চার দশকেরও বেশি সময় ধরে দলটি নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে কখনো বিএনপি অথবা আওয়ামী লীগের সঙ্গে এক ধরনের বোঝাপড়া করে রাজনীতি করে আসছিল।
তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দলটির বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতার বিচার শুরুর পর থেকেই প্রকাশ্য রাজনীতিতে কোণঠাসা হতে শুরু করে দলটি।
২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপির সঙ্গে মিলে বর্জন করলেও পরে বিএনপির সঙ্গেও সম্পর্ক নানামুখী চাপে পড়ে গেলে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর জোট থেকেই সরে আসে দলটি।
এবারের সংসদ নির্বাচনের আগে দলটি সভা সমাবেশের অনুমতি পেতে থাকলেও তা নিয়েও তখন নানা প্রশ্ন উঠেছিলো যে হঠাৎ কেন সরকার জামায়াতের প্রতি সদয় হলো। নির্বাচনের আগে বিএনপির সঙ্গে জোটে না থাকলেও নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে বিএনপির অনুরূপ কর্মসূচি ঘোষণা করে আসছিল দলটি।
শীর্ষ নেতারা মুক্ত, কৌশল নিয়ে দলে আলোচনা: নির্বাচনের পর দলটির আমির শফিকুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ও মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দসহ অনেক নেতাই কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এরপর নতুন পরিস্থিতিতে দলের কৌশল কী হবে তা নিয়ে নানামুখী আলোচনা শুরু হয়েছে।
গত দশই মার্চ ঢাকায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের দাবিতে মিছিলের কর্মসূচি নিয়ে নতুন করে রাজপথের কর্মসূচিও পালন করেছে দলটি।
পরওয়ার বলেছিলেন, আমরা এখন কোনো জোটে নেই। তবে ৭ জানুয়ারির নির্বাচন যারা বর্জন করেছিল তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে। কেবল নির্বাচন হয়ে গেল। আমরা এখন ইসলামপন্থি সংগঠন হিসেবে বিভিন্ন ইস্যুতে সক্রিয় হয়ে উঠব।
তবে দলের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বিরোধী অন্য দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই নিজেদের মতো কর্মসূচি পালন করলেও বিএনপির মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো পুরোপুরি বর্জনের চিন্তা নেই জামায়াতের মধ্যে।
বরং সামনের উপজেলা নির্বাচনে দলের কিংবা দলের কোনো ভালো অবস্থান যেখানে আছে সেখানে কেউ প্রার্থী হতে চাইলে দল থেকে বাধা দেওয়া হবে না বলেই জানা যাচ্ছে।
পরওয়ার বলেন, দীর্ঘদিন সরকার আমাদের কোণঠাসা করে রেখেছে। আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর সীমাহীন নিপীড়ন হয়েছে। এখন আমরা গণতান্ত্রিক পথেই সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের কাজ চালিয়ে যাব। সময় আসলে জনগণ যা চাইবে পরিস্থিতি বিবেচনা করে জামায়াত তেমন সিদ্ধান্তই নেবে।
জোবাইদা নাসরীন জানান, তার কাছে মনে হচ্ছে জামায়াত ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচির মাধ্যমে সংগঠনকে গোছানো এবং তার মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করবে সামনের দিনগুলোতে।
তিনি আরও বলেন, অনেকদিন প্রায় নিষিদ্ধের মতো ছিল দলটির অবস্থা। সভা সমাবেশের অনুমতি পেতে শুরু করেছে নির্বাচনের আগে থেকে। এখন আমার মনে হয় ভারতীয় পণ্য বর্জনের মতো ইস্যুগুলোতে তাদের নেতাকর্মীরা অনানুষ্ঠানিকভাবে সক্রিয় হয়ে জনমত গঠনের কৌশল নিতে পারে।